বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন শুধু একটি বনে সীমাবদ্ধ নয়—এটি এক জীবন্ত রহস্য, এক নিস্তব্ধ রূপকথা। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃত সুন্দরবন প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য এক চমৎকার ভ্রমণ গন্তব্য। এখানে বনের গভীরে হেঁটে বেড়ানো, নদীর বুকে ভেসে চলা এবং হঠাৎ হরিণ বা বানরের দল দেখে চমকে ওঠা—সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
সুন্দরবনে গেলে আপনি শুধু প্রকৃতি দেখবেন না, অনুভব করবেন এক শুদ্ধি। বনের মাঝখানে নৌকায় কাটানো এক রাত বা সকালে সূর্য ওঠার সময় বাঘের পায়ের ছাপ খোঁজা—সবই আপনার মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই পোস্টে আমরা জানাবো কিভাবে ঢাকা থেকে সুন্দরবনে যাওয়া যায়, কোন স্পটগুলো অবশ্যই দেখা উচিত, কোথায় থাকা যাবে এবং আনুমানিক খরচ কত হতে পারে।
ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য সুন্দরবন একবার নয়, বারবার যাবার মতো স্থান। প্রকৃতি এখানে এখনো আপনাকে ডাকে নিঃশব্দে।
ঢাকা থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার ভ্রমণ গাইডলাইন
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। ইউনেস্কো ঘোষিত এই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়, বরং প্রাণবৈচিত্র্যের এক অপার উৎস। যারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালোবাসেন, তাদের জন্য সুন্দরবন এক স্বপ্নের গন্তব্য। তাহলে চলুন জেনে নেই, কিভাবে ঢাকা থেকে সুন্দরবনে যাওয়া যায়, কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয় এবং কি কি দেখা যেতে পারে।
ঢাকা থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার রুট ও মাধ্যম
সুন্দরবনে যেতে হলে প্রথমে খুলনা বা মোংলা পৌঁছাতে হয়। ঢাকা থেকে খুলনা বা মোংলা যাওয়ার বিভিন্ন অপশন রয়েছে:
1. বাসে করে
ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ বা কল্যাণপুর থেকে গ্রিন লাইন, এস আলম, শ্যামলী, হানিফসহ বিভিন্ন এসি ও নন-এসি বাস চলে খুলনার উদ্দেশ্যে। সময় লাগে প্রায় 8-10 ঘণ্টা। খুলনা পৌঁছে লঞ্চে করে সুন্দরবনের নির্ধারিত অংশে যাওয়া যায়।
2. ট্রেনে করে
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে খুলনা রুটে রূপসা, সুন্দরবন, চিত্রা ট্রেন চলাচল করে। এই মাধ্যমটি অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক ও নিরাপদ। সময় লাগে প্রায় 9–10 ঘণ্টা। ট্রেনে ভ্রমণ করে আপনি রাতের মধ্যেই খুলনা পৌঁছে পরদিন সকালে ট্যুর শুরু করতে পারেন।
3. বিমানপথে
ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত বিমানে যেতে পারেন (যাত্রা সময় ৩০-৪০ মিনিট), এরপর যশোর থেকে খুলনা বা মোংলা যেতে হবে সড়কপথে (২-৩ ঘণ্টা)। যারা সময় বাঁচাতে চান, এটি একটি চমৎকার অপশন।
খুলনা/মোংলা থেকে সুন্দরবন
খুলনা বা মোংলা থেকে লঞ্চ, ট্রলার বা স্পিডবোটে সুন্দরবনের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে যাওয়া হয়। বেশিরভাগ পর্যটক ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে ১-৩ দিনের প্যাকেজ ট্যুরে যান যেখানে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা ও গাইড সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকে।
সুন্দরবন কি কি দেখবেন?
- করমজল ইকো পার্ক: মোংলার কাছেই অবস্থিত, কুমির ও হরিণ প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়।
- হারবাড়িয়া: ছোট নৌকা বা ট্রলারে করে সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ অভিজ্ঞতা।
- কটকা ও কচিখালী: বন্যপ্রাণী, হরিণ, বানর এবং মাঝে মাঝে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার সুযোগ রয়েছে।
- দুবলার চর: যারা অক্টোবর-নভেম্বরে যান, তারা মাছ ধরার মৌসুমি গ্রাম দেখতে পাবেন।
সুন্দরবনের আশেপাশে নতুন ও আরামদায়ক রিসোর্টে থাকার অভিজ্ঞতা
সুন্দরবন ভ্রমণ মানেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নিস্তব্ধতা আর প্রাণবৈচিত্র্যের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু এ ভ্রমণ আরও স্মরণীয় হয়ে ওঠে যদি থাকার জায়গাটাও হয় স্বস্তিদায়ক, নিরিবিলি ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা। বর্তমান সময়ে সুন্দরবনের আশেপাশে বেশ কিছু নতুন রিসোর্ট গড়ে উঠেছে যেগুলো ভ্রমণপিপাসুদের দিচ্ছে আধুনিক সুবিধা আর বনঘেরা এক শান্তিপূর্ণ আবাসন।
১. ন্যাচারস হেভেন রিসোর্ট (মোংলা)
এই রিসোর্টটি খুব কাছেই অবস্থিত করমজল ও হারবাড়িয়ার। নদীর ধারে নির্মিত কটেজগুলো প্রাকৃতিক বাতাসে ঘেরা, আর প্রতিটি রুমে রয়েছে এসি, ওয়াইফাই, হট ওয়াটার, সি-ভিউ ব্যালকনি। পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে একেবারে ঝামেলামুক্ত থাকা নিশ্চিত করে এটি।
২. সুন্দরবন ইকো রিসোর্ট (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা)
যারা সাতক্ষীরা দিক দিয়ে সুন্দরবনে যেতে চান, তাদের জন্য এই রিসোর্টটি দারুণ উপযোগী। এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে আছে কাঁচা ঘর, পুকুর, হাঁটার পথ ও বনের গন্ধে ঘেরা চারপাশ। লোকাল খাবারের স্বাদও অসাধারণ।
৩. ফরেস্ট এজ রিসোর্ট (খুলনা-মোংলা সড়ক)
সম্প্রতি নির্মিত এই রিসোর্টটি একটু বিলাসবহুল। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি এখানে রয়েছে সুন্দরবন ঘেঁষা কৃত্রিম জঙ্গল, হাঁটার ট্রেইল, কনফারেন্স রুম ও ফ্যামিলি স্যুট।
৪. টাইগারভিউ রিসোর্ট (মোংলা)
ছোট খরচে, মাঝারি মানের থাকা ও দারুণ লোকেশন পেতে চাইলে এটি ভালো অপশন। স্থানীয় গাইড ও নৌকা বুকিং এখান থেকেই পাওয়া যায়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য ফরেস্ট পারমিট প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ট্যুর অপারেটর এটি করে দেয়।
- গাইড ছাড়া বনে যাওয়া নিরাপদ নয়।
- ইনসেক্ট রেপেলেন্ট, হালকা পোশাক, ব্যাকআপ চার্জার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখুন।
- বন্যপ্রাণী দেখে উত্তেজিত না হয়ে নিরবভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।
সেরা সময় সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য
নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টি সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এসময় আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং জোয়ার-ভাটার কারণে বনের ভিতরে যাওয়া সহজ হয়।
ঢাকা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণ যতটা অ্যাডভেঞ্চারাস, ঠিক ততটাই প্রশান্তিদায়ক। এটি শুধুমাত্র একটি ট্রিপ নয়—বরং প্রকৃতির সাথে গভীরভাবে মিশে যাওয়ার এক অনন্য সুযোগ। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, নদী-খাল আর ম্যানগ্রোভ গাছ আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে।
সুন্দরবন ভ্রমণ শুধু দিনের অভিজ্ঞতা নয়, রাতের নির্জনতাও এখানে এক স্বপ্নের মতো। তাই একটি ভালো রিসোর্টে থাকা পুরো ট্রিপের মান বাড়িয়ে দেয়। প্রাকৃতিক পরিবেশে নির্মিত এসব নতুন রিসোর্টে থাকতে গিয়ে আপনি পাবেন প্রকৃতির সান্নিধ্য ও আধুনিক জীবনের স্বস্তি—একসাথে।
আপনার আগামী সুন্দরবন ট্রিপে এমন একটি রিসোর্ট বেছে নিয়ে করুন স্মরণীয় ও আরামদায়ক এক অভিজ্ঞতা।
যারা এবার ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছেন, তাদের জন্য সুন্দরবন হতে পারে সেরা একটি গন্তব্য।

